|

প্রবাসী বাঙ্গালীর দূর্গাপূজো

শরতের নীলাকাশ,কাশবনের সমারোহ কি মনোরম আবহাওয়া ।

কিন্তু এখন বসে বসে এইসব উপভোগ করার সময় আমার নেই।রেডি হয়ে অফিসে যেতে হবে ।ব‍্যস্ত জীবন আমার এখন।বস কে এতো করে বললাম তাও ছুটি দিলনা।কি আর করা যাবে ,বেরোই।এইসময় কে আবার ফোন করল ?দেখি একবার অনেক বার করেছে দেখছি।আবার করছে তুলি ফোন টা।

-:হ‍্যালো বাবু ,আমি তোর মা বলছি ।এটা তোর ভাইয়ের ফোনের নাম্বার।

-:হ‍্যালো মা , বলো কি বলবে ?সরি মা ব‍্যস্ত ছিলাম গো, কাজে তাই ফোন ধরিনি।

-:মাকে কেউ সরি বলে পাগল ছেলে একটা । কিন্তু তোর কাজ টা আমাদের থেকেও  কি বেশি জরুরী বাবু?

-:সেটা নয় মা।

-:তাহলে কত ব‍্যস্ত তুই? যে মার ফোন ধরতে পারিস না।

-:কি করব বলো জানোই তো সব তবুও।

-:আচ্ছা সেসব কথা এখন বাদ দে। বাবু তুই আসবি কবে সেটা বল?তুই এলে তবেই তো কেনাকাটা করব সবাই মিলে।

-:আমি যেতে পারবো না মা। এবারেও ছুটি পাইনি ব‍্যাংকে টাকা পাঠিয়েছি তোমাদের জন্য । পূজোর কেনাকাটা করে নিও তোমরা ভাই আর বোনের জন্য এক্সট্রা টাকা পাঠিয়েছি ওদের যা লাগবে কিনে দিও।

-:আর তুই কি করবি পূজোতে?  কাজ তাইতো। থাক তুই তোর কাজ নিয়ে । তোর সাথে কি আমাদের শুধু টাকার সম্পর্ক বাবু  বল আগে?আমাদের ও তো শখ হয় সারা বছর পর ছেলে ফিরলে পূজোর কটা দিন তার সাথে আনন্দ করে কাটাতে ।

-:মা রেগে যেওনা প্লিজ। কাজের এতো প্রেসার তাই ছুটি পাইনি।পরের বছর ঠিক ছুটি ম‍্যানেজ করে যাব।

-:আগের বছরও ঠিক একই কথা বলেছিস তুই, আর কবে আসবি তুই আমরা মরে গেলে।

-:এইরকম বলো না চেষ্টা করছি তো, বলো ছুটি পাওয়ার ।না পেলে কি করব।

-:তোকে ভালো চাকরি করতে বলেছিলাম বলে ,তুই এইভাবে আমাদের শাস্তি দিবি বল?

-:সেটা কখন বললাম ,সত্যিই কাজের খুব চাপ একটু বোঝার চেষ্টা করো।

-:তোর খুশির জন্য আমাদের থেকে দূরে যাওয়াতে বাধা দিইনি তোকে কারণ, তুই ভালো করে জানিস ছোট থেকে এখনো পর্যন্ত তোর উপর আমাদের কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিইনি ।শুধু মাত্র ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বারন করেছি।

-:মা প্লিজ কেদো না।রাখছি আমি বাই।

-:হ‍্যা রাখ, আমাদের জন্য তোর এখন সময় নেই জানি আমি ।বড় হয়েছিস টাকা রোজগার করছিস নিজের মর্জি মতো চলবি ;অবশ্য এটাই স্বাভাবিক ।ভালো থাকিস নিজের খেয়াল রাখিস।আর সময় হলে বুড়ো বাপমাকে একটু ফোন করিস।দূরে থাকিস চিন্তা হয় তোর জন্য ।

-:বেকার চিন্তা করছ তোমরা ,আমি ঠিক আছি। শরীর টা খারাপ করবে  কিন্তু,বেশি চিন্তা করলে।

-:বাবা মা হলে বুঝতে পারবি, ছেলে দূরে থাকলে কতটা চিন্তা হয়।

-:আচ্ছা রাখছি ,এখন নিজেদের খেয়াল রাখবে ।ভালো করে পূজো কাটাও।

আমি শঙ্কর, একটু আগে যার সাথে কথা বলছিলাম। উনি হলেন আমার মা , পূজোতে ছুটি পাইনি। সেই কথা শুনে গঙ্গা, যমুনা ইত্যাদি নদীর জল কেদে ভাসিয়ে দিলেন।

তবে মা ছাড়া আর একজন আছে যার জন্য আমার মনটা খারাপ আমার আশায় বসে আছে পথ চেয়ে এবারের পূজোতে ও যেতে পারলাম না কি জানি পাগলীটা কি ভাবছে মনে করছে তাকে হয়তো ভুলে গেছি ইচ্ছে করে ছুটি নিইনি ,সেতো আর জানে না আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে তাকে ছেড়ে থাকতে ।

কি সৌভাগ্য আমার মনে করতে না করতেই পাগলীর ফোন।

-:হ‍্যালো পাগলী।

-:কে পাগলী?আমি কারোর পাগলী নয়।আমার একটা নাম আছে সেটা ধরে ডাকলে ই খুশি হবো।

-:জানি তো আমি।আমার পাগলীটা র একটা মিষ্টি নাম আছে।

-:তাহলে নাম ধরে ডাকুন।

:-আমি তো পাগলী বলেই ডাকব।আমার পাগলীটা বড্ড বেশি রেগে আছে আজ আমার উপর ।সরি পাগলী প্লিজ মাফ করে দাও রেগে থেকো না।

-:রাগ করবো না তো, কি করব? এই পূজো তেও তুমি এলেনা ।এইবছরেও আমায় একা একা পূজো কাটাতে হবে ।প্লিজ চলে এসো ,তুমি ভালো লাগে না তোমাকে ছাড়া।

-:জানিতকিন্তু কী করব বলো? ছুটি না পেলে। আর এটার জন্যে ই তোমার বাবা আমাদের বিয়েতে রাজি হয়েছে।এটাই তো আমাদের প্রেমের সম্পর্কের ছাড়পত্র।একটু অপেক্ষা করো প্রমোশন টা পেয়ে গেলেই তোমাকে বিয়ে করে নেব , সোনা।সবই তো জানো, এইটুকু না হয় সহ‍্য করে নাও।

-:জানিতো ,বড্ড বেশি ভালোবাসো তুমি আমায় নাহলে কি পরিবার প্রিয়জনের থেকে দূরে যায়; কেউ শুধু মাত্র নিজের প্রেম কে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য।আমিও নাহয় একটু বিরহের কষ্ট সহ‍্য করি।

-:এই কাদছো নাকি প্লিজ তুমি কান্না করোনা ।তুমি কষ্ট পেলে আমি যে দূর্বল হয়ে পড়ব সোনা।তুমিই তো আমার শক্তি ।তুমি ভেঙে পড়লে কিকরে চলবে বলোতো।তবে রেগে গেলে আমার পাগলীটা কে অনেক সুন্দর লাগে।

-:হম ,আর কাদবো না আমি তাহলে হবে তো,সুন্দর লাগে না ছাই! পেতনি লাগে পেতনি।নিজের খেয়াল রাখবে তুমি ঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়া করো।রাখছি বাই লাভ ইউ।

-:মোটেও না একদম ই ওইরকম লাগে না অনেক সুন্দর লাগে বুঝলে।হম তুমিও,রাখছি পরে কথা হবে লাভ ইউ  টু সোনা।

ইনি হলেন আমার একমাত্র প্রেমিকা মিস উমা দত্ত ,বেশ মিল আছে আমাদের নামে তাই বন্ধুরা মজা করে একসাথে উমাশঙ্কর বলে ডাকত।

আমারও কষ্ট হয় কিন্তু, কি করব যখনই কোনো কাপল দেখি;পাগলীটার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো মনে পড়ে যায়।চাইলে ও পাগলীটা কে কাছে পাইনা।এখনো চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে, আমাদের প্রথম কিস করার মুহুর্তটা  !কতটা নার্ভাস ছিলাম দুজনে ওটা করার পর দুদিন দেখা করেনি পাগলিটা লজ্জায়।পূজোতে হাতে হাত ধরে ঘুরতে যাওয়া।এইসব মনে করে কাটাতে হবে এখন আর কোন উপায় নেই।

ষষ্ঠীর দিনে কতো মজা হতো।মা বাড়িতে লুচি আলুর দম পায়েস নানারকম খাবার বানাতো ।সেই নিয়ে ভাইবোনের সাথে কত খুনসুটি করেছি।তারপর কার কটা জামাকাপড় হবে ,সেই নিয়ে মারামারি আমার কেন কম হবে? ভাইবোনের কেন বেশি হবে? শেষে বাবাকে নালিশ। তখন বাবা বলত, তুমি তো বড় বাবূ ওরাতো ছোট আর ছোট দের কে মারতে নেই ভালো ছেলেরা মারামারি করে না।সত্যিই খুব মিস করি, সেইদিন গুলো এখন বুঝতে পারছি ;বাবা কেন বলতো ওইসব।দূরে থাকি ভাইবোন দুটো কে দেখা তো দূরের কথা ঠিক করে কথাও বলতে পারি না।

আমাদের সময় তো মহালয়া থেকে ই পূজো শুরু হতো।পাড়ার প‍্যান্ডেল বসে থাকতাম, তার পর পূজো কটাদিন জমিয়ে আনন্দ উপভোগ করতাম ।পড়াশোনা থেকে ছুটি; পূজো কটাদিন বড়দের বকুনি থেকে ও মুক্তি কি যে সুন্দর মুহুর্ত বলে বোঝানো যাবে না।এইসব মুহূর্তগুলো মনে করেই এবারের পূজো নাহয় কাটিয়ে দেব।

এখন সেসব অতীত যতদিন যাচ্ছে সেই খুশির মুহুর্তগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।যতই আধুনিক হইনা কেন মনে প্রাণে বাঙালি তো আমরা।আসলে মূল্যবোধ অনুভূতি সব ছেড়ে আমরা যান্ত্রিক হয়ে উঠেছি তাই হয়তো এইসব হচ্ছে।

কিছু  পাওয়া আর না পাওয়াই হল প্রবাস জীবন আর এটাকে মেনে নিয়ে ই জীবনের পথে এগিয়ে যারা তারাই হল প্রবাসী।

বি:দ্র:আমারা অনেকেই মনে করি প্রবাসজীবন সুন্দর। বিদেশে থাকার মজাই আলাদা ।তবে যারা থাকে তারাই জানে,  নিজের দেশ অথবা পরিবার প্রিয়জনের থেকে দূরে থাকাটা কতটা কষ্টের ।সবকিছুরই ভালো খারাপ দিক আছে ,তবে নিজের আপনজন দের থেকে দূরে থাকাটা সত‍্যি ই কষ্টের।

সমাপ্ত।।

Share this Post

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *