দুগ্গা মা এলেন বলে কথা
বাতাসে শিউলির গন্ধ, ঘাসে শিশির বিন্দু, কাশফুলের গয়না আর কুয়াশার মৃদু ওড়না গায়ে জড়িয়ে শরৎ এসে হাজির আমাদের দোর গোড়ায়, সাথে নিয়ে অনেক আশা-আকাঙ্খা ও বুক ভরা ভালোবাসা। এই ঋতুতেই আলতা রাঙা পায়ে শিশির ভেজা ঘাসে পা রেখে শিউলির সুবাস সঙ্গে নিয়ে পেঁজা তুলোর মেঘের ভেলায় ভেসে ঘরের মেয়ে উমা আসেন বাপের বাড়িতে। তিনি যেমন আমাদের ঘরের মেয়ে ঠিক তেমনই জগৎজননী মা, মা ও মেয়ের মেলবন্ধনে তিনি হয়ে উঠেন অনন্যা। শক্তি ও ভক্তির সহযোগে তিনিই আবার যোগমায়া। তিনি যেমন অশুভ শক্তির বিনাশিনী, তেমনই পরম আদরে কোলে টেনে নেন নিজের সন্তান সন্ততিদের। আপনভোলা শিবের ঘরণী হয়েও মেতে থাকেন পুরো জগৎ সংসার নিয়ে। তাই তো তিনি দশভূজা। দশ হাতে সামাল দেন পুরো ব্রহ্মাণ্ড-কে। তাই মা দুর্গার আগমনে প্রকৃতি নিজেকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে তোলে। শরতের স্নিগ্ধ নীলাকাশ জানান দেয় আমাদের ঘরের মেয়ে আমাদের মা আসছেন আমাদের কাছে।
পিতৃপক্ষের তর্পণ শেষে দেবীপক্ষের সূচনাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ ও ঢাকের বোলে মৃন্ময়ী মা হয়ে উঠেন চিন্ময়ী। ষষ্ঠীতে মা-এর বোধনের সাথে বোধন হয়ে যায় আনন্দ-হুল্লোড় ও মজার, আড়ি হয়ে যায় দুঃখ, বিষাদ ও মনখারাপের সাথে। পূজোর চারদিন যেন সবাই বাঁধভাঙা উচ্ছ্বসিত আনন্দ নদী। প্রবাসীরা ফিরে আসে নিজ ঘরে। তাই এ শুধু আমাদের উৎসব নয়, আমাদের মেলবন্ধন। যতোই সময় পাল্টে যাক, যতোই আধুনিকতা আসুক, যতোই জেন ওয়াই, জেন নেক্সট বলে রব উঠুক, পূজোর চারদিন জিন্স ছেড়ে পাঞ্জাবী আর শাড়ি গায়ে না জড়ালে কিন্তু চলে না। এটিই হলো নাড়ীর টান। বৈঠকখানা ও পাড়ার মোড় ছাড়িয়ে আড্ডা যতই রক আর রেস্টুরেন্টে চলে আসুক, পূজোর আড্ডা কিন্তু চাই-ই, আর সাথে কব্জি ডুবিয়ে ভুরিভোজ। পুরো বছর ডায়েট নিয়ে মাথাব্যাথা ঝেড়ে ফেলে ফুলকো লুচি, আলুর দম, সর্ষে ইলিশ ও কষা মাংস না হলে কিন্তু কারো চলে না। অষ্টমীর খিচুড়ি ভোগের লাইনে দাঁড়িয়ে যতই সেলফি উঠি না কেনো, পিৎজা, বার্গার, কে এফ সি এর বাতানুকূল পরিবেশে বসে যতোই খাওয়া-দাওয়া করি, লাইনে দাঁড়িয়ে খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা না হলে চলবে কেন? সেলফি কিং বা সেলফি কুইন হলেও শারদ – সুন্দরী ক্যাপশনটার মানেটাই কিন্তু আলাদা। হিপ্-হপ্ ড্যান্স-এ কোমর দোলাতে পারলেও ধুনুচি নাচ যেনো আলাদা মাত্রা যোগ করে আমাদের বাঙালিয়ানায়। হ্যাঁ হতে পারে সময়ের সাথে সাথে হয়তো কিছুটা পাল্টেছে, কিন্তু শেকড়ের টান যায়নি কোনদিনই, আর যাবেও না।
পরিস্থিতির চাপে এ-বার মা না হয় একটু অন্যরকম ভাবেই পূজো পাবেন, সোশ্যাল ডিস্টান্সিং মেনে চলবেন। ইতিমধ্যে তো মা কোয়ারেন্টাইন কাটিয়েও আসলেন। মা যেমন যুগে যুগে অশুভ শক্তির জয় ঘটিয়েছেন, এবারও করোনাসুর কে বধ করে এই অস্থির, প্রতিকূল সময়ের অবসান ঘটাবেন, বিজয়ার কোলাকুলিতে থাকবে না আর কোনো অহেতুক চিন্তা।
শেষে গানের ভাষায় মা-কে বলতে ইচ্ছা করছে- “ও ঠাকুর যেওনা বিসর্জন, হাসিমুখ থাকুক প্রিয়জন।”কিন্তু মা-তো বিশ্বজননী, তাই এক চোখে হাসি আর এক চোখে জল নিয়ে এটাই বলি –
“আসছে বছর আবার হবে।”