জন্মদিনের উপহার
নমস্কার বন্ধুরা, পরিস্থিতি যদিও প্রতিকূল তবু আশা করছি আপনারা সবাই সুস্থ আছেন। আজ বইয়ের তাক গুছোতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো আমাদের কলেজের একটি ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটা খুলে কিছু পাতা উল্টোতে থাকি। অনেক ভালো ভালো লেখা আর লেখকের নাম আমাকে মনে করিয়ে দিল কলেজের দিন গুলো। সত্যিই দিনগুলো স্মরণীয়। পাতাগুলো উল্টোতে উল্টোতে চোখে পড়ে আমারই লেখা একটি ছোট্ট গল্প। ভাবলাম আপনাদের সাথে শেয়ার করি।
জন্মদিনের উপহার
(রাধামাধব কলেজ ম্যাগাজিন ‘পত্রপুট-২০১৪-১৫’তে প্রকাশিত। পৃষ্ঠা-৬৮,৬৯)
(১)
অক্টোবর মাসে এক ফুরফুরে সকাল । মাত্র কয়েকটা দিন পরই দুর্গাপূজা।
বড় রাস্তায় মোড়ের দোকান থেকে কিছু জরুরী জিনিসপত্র কিনে তুলি বাড়ি ফিরছিল; হঠাৎ বাবার বন্ধু শংকরকাকুর সাথে দেখা –
শংকরকাকু – কিরে তুলি! কেমন আছিস? পুজোর কাপড় কয়টা হল?
তুলি – ভালো আছি কাকু, বাবা কালও বলেছিলেন তোমার কথা। অনেকদিন হলো আমাদের ঘরে যাওয়া হয়নি।
শংকরকাকু – কি করব বল? ক’দিন ধরে বড় ব্যস্ততা। পাড়ার ছেলেরা সবাই মিলে এবার আমাকে পুজো কমিটির সেক্রেটারি বানিয়েছে। কত কাজ!
তুলি- তাই নাকি কাকু! এবার তোমাদের পুজো প্যান্ডেলের ‘থিম’ কি?
শংকরকাকু – এবছর তোর স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ, তাই স্বামীজিই এবার আমাদের পুজোর ‘থিম’। কলকাতা থেকে শিল্পী আনিয়েছি। বিবেকানন্দের বাণী আর ছবিতে ভরা থাকবে পুরো প্যান্ডেল।
কাকুর কথা শেষ হতেই নোংরা হাফপ্যান্ট পরা ছোট্ট একটি ছেলে ওদের পাশে এসে দাঁড়ালো।
ছেলেটি- বাবু, কাল থেকে কিছু খাইনি; দুটি টাকা দাওনা।
তুলি- এই নাও পাঁচ টাকা, কিছু কিনে খেয়ে নাও।
শংকরকাকু – কিরে তুলি! তুই টাকা দিতে গেলি কেন? জানিস না, এগুলো সব এদের চালাকি। ঠিক খেয়ে দিয়ে বেরিয়েছে ভিক্ষা করতে। ( ছেলেটির দিকে তাকিয়ে) যাও, আমার কাছ থেকে কিছু পাবে না । রাস্তায় বেরোনোই দেখছি যন্ত্রনা!
ছেলেটির রুগ্ম শরীর দেখে তুলির মনে হলো না যে ছেলেটি মিথ্যা বলছে। আর কথা বাড়ালো না।
তুলি- আচ্ছা কাকু, এখন আসি। সময় করে এসো একদিন ঘরে।
শংকরকাকু – হ্যাঁ হ্যাঁ যাব। তোরা সবাই আসবি কিন্তু আমাদের পুজোয়।
(২)
ঘরে এসে জিনিসপত্রগুলো রাখতে না রাখতেই দরজায় কলিংবেলের শব্দ। খুলে দেখল দাদার বন্ধু সুদীপ।
তুলি- আরে, সুদীপদা যে! ভেতরে এসো; দাদা তো ঘরে নেই।
সুদীপ- ও, রাজীব ঘরে নেই। আচ্ছা, আন্টিকে একটু ডেকে দে-না।
তুলি- (চেঁচিয়ে) মা, ও মা, সুদীপদা এসেছে ।
তুলির মা- ( রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে) ও, সুদীপ এসেছিস, বস বাবা।
সুদীপ – না আন্টি, এখন বসবো না। এসেছি একটা কাজে। আমাদের ‘অন্ধজনে দেহ আলো’ ক্লাবের পক্ষ থেকে স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে বছরব্যাপী অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। আগামীকাল রবিবার, সকাল দশটায় আমাদের ক্লাব ঘরের সামনে স্বামীজীর আবক্ষ মূর্তি উন্মোচিত হবে, একটি ছোট্ট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। তোমরা সবাই যাবে কিন্তু। (হঠাৎ সুদীপের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো)
সুদীপ- (ফোনটা কেটে দিয়ে বিরক্তি মাখা মুখে) ইস, জ্বালিয়ে খেলো দেখছি!
তুলি- কি ব্যাপার সুদীপ দা ?
সুদীপ – আর বলিস না, আমার পাশের বাড়িতে এক বুড়ি থাকে। সাতকুলে কেউ নেই। কাল থেকে নাকি শরীর ভালো না। সকাল থেকে ফোন করে জালাচ্ছে – ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবো; আচ্ছা, আমার কি আর কোন কাজ নেই?
তুলি- কি করবে বলো? ( মনে মনে- সারাদিন বাইক নিয়ে ঘুরঘুর করা ছাড়া আর কোন কাজ করতে তো দেখিনা।)
সুদীপ- যাক গে, এখন আসি। রাজীবকে বলিস আমি এসেছিলাম।
(৩)
দুপুরে তুলি বসে টিভি দেখছে। ছোট বোন তিতলিও তৃতীয় স্কুল থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে টিভি দেখতে বসলো।
তিতলি- দিদি, আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি?
তুলি- কি কাজ আবার?
তিতলি- শোনো না, আজ স্কুলের মেম বলেছিলেন যে স্বামী বিবেকানন্দের 150th জন্মদিন উপলক্ষে পরশুদিন স্কুলে একটা ‘Essay competition’ হবে। বিষয়- ‘স্বামী বিবেকানন্দের জীবনাদর্শ’। আমি নাম দিয়েছি। তুই আমাকে একটা সুন্দর essay তৈরি করে দিতে পারবি?
তুলি- শখ করে নাম দিয়েছ, এখন নিজেই রচনা তৈরি করো। বাড়িতে স্বামীজীর উপর কিছু বই আছে। সেগুলো পড়ে নিস, আইডিয়া পাবি।
তিতলি- ইস , স্কুলের এত সমস্ত পড়া শেষ করে আমি ওই বইগুলো আর পড়তে পারবো না। তোর তো এখন ছুটি। দে না প্লিজ তৈরি করে; আমি মুখস্ত করে নেবো। প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!
তুলি- আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। দেওয়া যাবে’ খন।
(৪)
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর তুলি তিতলির জন্য রচনা তৈরি করতে বসলো। ঘরের স্বামীজীর বিষয়ে যে কয়টি বই ছিল সেগুলো নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো। তখন স্বামীজীর কিছু বাণী ও তার জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে চোখে পড়ল। এক জায়গায় তিনি বলেছেন যে পথহারা সমাজকে আবার সুন্দর সমাজে পরিণত করার জন্য তাঁর কিছু মানুষ দরকার। সে মানুষকে হতে হবে সৎ, দরদী, জ্ঞানী ও প্রেমিক। মানুষ গড়াই ছিল স্বামীজীর স্বপ্ন। তুলির চোখে পড়ল স্বামীজীর ছোটবেলার একটি ঘটনা যেখানে এক আহত সৈনিক কে সাহায্য করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। কর্তব্যে অবহেলা না করে সেবা যত্নের মাধ্যমে সুস্থ করে তুলেছিলেন সৈনিকটিকে।
তুলি বই বন্ধ করলো। চোখ বুজে আজকের দিনের ঘটনাগুলো মনে করতে লাগলো। স্বামী বিবেকানন্দ সমাজের মানুষের মধ্যে যেসব গুণের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলাম তার কিছুমাত্রও তো সে শংকরকাকু, সুদীপদা – এর মত তথাকথিত ‘স্বামীজীর ফ্যান’ – দের মধ্যে দেখতে পেল না। তুলির বারবার মনে হতে লাগল- তবে কি, ‘পুজোর থিমে’, স্বামীজীকে এনে তার ‘আবক্ষ মূর্তি’ উন্মোচন করে কিংবা তাকে নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতা করেই আমরা আমাদের দায়ভার সারতে চাইছি? তবে কি, সার্ধশতবর্ষে এইটুকুই ছিল আমাদের পক্ষ থেকে স্বামীজীর জন্মদিনের উপহার?